হঠাৎ করে, ভাগ্যক্রমে

পুরুলিয়ায় আমার সেই আবাসিক বিদ্যালয়-এর গল্প বলেছিলাম ক’দিন আগে? আবার সেখানে ঘুরে আসি। আসলে ওই তিনটে বছর বেশ কেটেছিল, টুকরো টুকরো করে অনেক ঘটনা, অনেক স্মৃতি জমা হয়ে আছে। সেই সময়ে আমার জীবনে একটা স্ট্রাকচার দরকার ছিল (সেদিন বুঝিনি, কিন্তু পরে বুঝেছি) – এই প্রয়োজনটা সকলের সমান ভাবে হয়না। অনেকেই বেশ স্বয়ংসিদ্ধ ভাবে নিজেদেরকে ম্যানেজ করে নিতে পারে। তারা নমস্য ব্যক্তি, কিন্তু হোস্টেল-এর ওই নিয়মনিষ্ঠ বাঁধাধরা জীবন – সময়ে পড়া, সময়ে খেলা, সমানভাবে সমস্ত অ্যাক্টিভিটিতে অংশগ্রহণ – আমাকে, একান্তভাবেই আমার নিজের দিক থেকে, ফোকাস্‌ড্‌ হতে সাহায্য করেছিল। আবার বলছি, এটা আমার নিজস্ব অনুভূতি, এই ব্যাপারে কোন ওয়ান-সাইজ-ফিটস্‌-অল -এর প্রশ্ন নেই।

যাউকগ্যা, ভারী ভারী কথা কইয়া কাম নাই। পুরুলিয়ার অভ্যন্তরে একটা বিশেষ জায়গা জুড়ে আমাদের স্কুলটা ছিল। জায়গাটার একটা বৈশিষ্ট্য ছিল। ধূধূ ন্যাড়া প্রান্তর, শুকনো টাইপের মাটি, তারই মধ্যে দিয়ে চলে গেছে একটা পিচঢালা পথ – তার প্রস্থ মোটামুটি দুটো টিনের বাস পাশাপাশি চলতে পারার মত। রাস্তার দুইধারেই পিচ-এর অংশটা পেরোলেই মাটি, একটু খালের মত নিচে নেমে গেছে। ওই পুরোনো দিনের ওয়েস্টার্ন সিনেমাগুলো যেরকম টেক্সাস বা অ্যারিজোনার একটা চিত্র দেখা যেত, অনেকটা সেই রকম। শুধু একটা ইম্পর্ট্যান্ট তফাৎ ছিল। পুরুলিয়ার ওই রাস্তাটার দুধারে থেকে থেকেই বড় বড় গাছ দেখা যেত, যে গাছগুলো তাদের ঝাঁকড়া ডালপালা পাতাপুতা নিয়ে রাস্তার ওই অংশগুলোকে ছায়ায় ঢেকে রাখত। এর পিছনে নাকি একটা চমকপ্রদ কারণ ছিল – সত্যিমিথ্যে জানিনা অবশ্য। ওই সব অঞ্চলের আদি বাসিন্দা যারা, আদিবাসী জনজাতি, তাদের নাকি একটা দুর্দান্ত প্রথা ছিল – কোন পরিবারে কেউ জন্মালে তা সেলিব্রেট করতে, বা কেউ মারা গেলে তার শোকপালন করতে, তারা বৃক্ষরোপণ করত। সেই কারণে কাসাই নদীর উত্তরে স্থিত অযোধ্যা পাহাড়ের কোলে লালমাটির দেশ পুরুলিয়া সাধারণভাবে একটু শুষ্কপ্রধান অঞ্চল হলেও ঊষর, অনুর্বর নয়। কি চমৎকার কাস্টম, নয়?

সেই রাস্তার পাশেই কোন একটা অঞ্চলে বেশ অনেকটা জায়গা জুড়ে হঠাৎ করে গজিয়ে উঠেছে আমাদের স্কুল। “গজিয়ে উঠেছে” টা ফরাসী ভাষায় লে মো জুস্‌ত, অর্থাৎ একদম সঠিক অভিব্যক্তি। কারণ চারপাশ বেশ ফাঁকা ফাঁকা, আর তারই মধ্যে আচমকা বিশাল একটা দেওয়াল ঘেরা কম্পাউণ্ড, যেন মাটি ফুঁড়ে বেরিয়েছে। দেওয়ালের ভিতর দিকে আবার সমদূরত্বে আম এবং অর্জুন গাছের সারি। সেই কম্পাউণ্ড-এর ভিতরেই মন্দির, জুনিয়র এবং সিনিয়র স্কুলবাড়ি, বিশালকায় জুনিয়র হোস্টেল, সপ্তম থেকে দশম শ্রেণীর ছাত্রদের জন্য চারটে সিনিয়র হোস্টেল, অফিসবাড়ি, ডাইনীং হল, জিমখানা এবং তার পাশেই বিশাল বড় বড় মাঠ, ভলিবল এবং বাস্কেটবল-এর কোর্ট, লাইব্রেরী, ইনফার্মারী বা হাসপাতাল, গেস্ট হাউস, ব্যাঙ্ক এবং পোস্ট অফিস, আবার একটা আলাদা অঞ্চল জুড়ে শিক্ষকদের পরিবার সহ থাকার কোয়ার্টারস, পোল্ট্রি, ডেয়ারী, বিশাল সবজী বাগান এবং আরও কত কি – প্রায় সওয়া দুই বর্গ কিলোমিটার সব মিলিয়ে।

স্কুল কম্পাউণ্ড-এর মুখ্য প্রবেশদ্বারটা বেশ জমকালো। এমনকি সংস্কৃত শ্লোক-টোকও লেখা আছে। যদিও যেদিন প্রথম এসে ঢুকেছিলাম, সেই দান্তে-বাবুর দিব্য কৌতুকের প্রথমাংশ ইনফার্ণো-র বিখ্যাত লাইন, “অ্যাবাণ্ডন অল হোপ, য়ি হু এন্টার্স হিয়ার”, সেটাই যেন বার বার মাথায় ঘুরছিল, কিন্তু পরবর্তী কালে তা ঠিক অতটা দুর্বিষহ ছিল না। মেইন গেট-এর ঠিক উল্টোদিকে, রাস্তার অন্য ধারে একটা রিক্সাস্ট্যাণ্ড আর ঝুপড়ি মতন একটা চায়ের দোকান। এই রিক্সাকে ঘিরেই আমার ছোট্ট গল্প।

পুরুলিয়ার রিক্সা

পুরুলিয়ার শহরাঞ্চল থেকে আমাদের স্কুল প্রায় ছয় কিলোমিটার দূর। শহর থেকে আরও দেড় কিলোমিটার দূরে ট্রেন স্টেশন – পুরুলিয়া জং, মানে বেশ পুরোনো জংধরা ঐতিহ্যশালী স্টেশন আর কি। আমার সময়ে দুটো মেজর ট্রেন ছিল কলকাতা থেকে, পুরুলিয়া এক্সপ্রেস আর হাওড়া-আদ্রা-চক্রধরপুর প্যাসেঞ্জার। এই দ্বিতীয়টাতেই আমার বেশী যাতায়াত ছিল, কারণ সেটা হাওড়া থেকে রাত্রে ছাড়ত আর পরদিন ভোরবেলা পুরুলিয়া পৌঁছে যেত। স্টেশন থেকে বেরিয়েই রিক্সাস্ট্যাণ্ড (পরের দিকে অবশ্য অটোস্ট্যাণ্ডও হয়েছিল); বাসও যেত বোধহয় দু’একটা, কিন্তু যেহেতু আমার সঙ্গে সবসময়ই একটা ভারী ট্রাঙ্ক থাকত, তাই সেটা সামলে বাস-এ ওঠা সম্ভবপর ছিলনা। অগত্যা, রিক্সা। ছুটিছাটার শেষে স্কুল-এ ফিরে আসার সময় মা আসত আমার সঙ্গে আমাকে ছেড়ে যেতে, তাই আমি আর মা ট্রাঙ্কটাকে রিক্সায় তুলে তাতে চেপে বসতাম স্টেশন থেকে। সাইকেল রিক্সা, কিন্তু সেগুলো ঠিক কলকাতার চিরপরিচিত সাইকেল রিক্সার মত ছিল না। কলকাতার রিক্সায় উঠে চেপে বসলেই সব জায়গা খতম, পায়ের কাছটা ছাড়া আর কিছু রাখার অবকাশ নেই; কিন্তু পুরুলিয়ার রিক্সাতে বসার জায়গার পিছনের দিকে একটা খোপ করাই থাকত (লাল তীরচিহ্ন), সেখানেই সবাই মালপত্র ঠেসে দিত। এতটাই জায়গা থাকত যে একটা ট্রাঙ্ক, আর একটা বড়সড় ব্যাগ সহজেই ধরে যেত।

আমার ছোটবেলায় তখনও পুরুলিয়া স্টেশন-এ রিক্সা এবং রিক্সাচালকের সংখ্যা মুষ্টিমেয় ছিল। তাই মোটামুটি তাদের সঙ্গে পরিচয়ও ছিল। যেহেতু রাস্তা অনেকটা, প্রায় সাড়ে সাত কিলোমিটার – যেতে বেশ চল্লিশ মিনিট থেকে একঘণ্টা মত লাগত, তাই চলতে চলতে রিক্সাচালকদের সাথে প্রচুর গল্প হতো। ইন ফ্যাক্ট, ওই আদিবাসীদের গাছ লাগানোর প্রথার কথাও আমি তাদেরই কাছ থেকে জানতে পারি।

“মাহাতো” পুরুলিয়া অঞ্চলে একটা জনপ্রিয় পদবী। মাহাতোরা কুর্মি সম্প্রদায়ভূক্ত বাঙালী হিন্দু, তাদের আদি নিবাস ছোটনাগপুর সমভূমি অঞ্চলে বিস্তৃত, অর্থাৎ পুরুলিয়া, বর্তমান ঝাড়খণ্ড এবং উড়িষ্যার কিয়দংশ। যদিও আদিকালে তারা চাষবাস নিয়েই থাকত, কিন্তু সময় পরিবর্তনের সাথে সাথে তারা বিভিন্ন পেশায় ছড়িয়ে পড়েছে। আমাদের স্টেশন থেকে স্কুল রিক্সাযাত্রার প্রায় সমস্ত সারথিই মাহাতো ছিল (সেটাও জানা ওদেরই একজনের কাছ থেকে)।

আমি তখন ক্লাস নাইন-এ পড়ি। গ্রীষ্মাবকাশের পর ফিরে আসছি। আমাদের ছুটির সময় প্রচুর হোমওয়ার্ক দিয়ে দেওয়া হোতো; কিন্তু সেগুলো সব হয়ে গেছে (ঠিক আছে ঠিক আছে, নো নীড টু রোল ইয়োর আইজ!), তাই মনে আনন্দ, নতুন সেশন শুরু হবে সেই নিয়ে আবার উৎকণ্ঠাও বটে। সব মিলিয়ে অস্থির, তাই রিক্সাচালক-এর সঙ্গে আড্ডা শুরু হয়ে গেল। কথায় কথায় জানতে পারলাম তার মাস দেড়েক আগে পুত্রসন্তান জন্মেছে, তাই তার প্রাণে প্রচুর পুলক – সে তার ছেলের অনেক গল্প শুনিয়ে ফেলল, ছেলে যে ‘ধাঁইকিরিকিরি’ (অর্থাৎ তাড়াতাড়ি) বড় হয়ে যাচ্ছে সেটা জানলাম। আমরা প্রায় স্কুলের কাছে পৌঁছে গেছি, আর মিনিট নয়-দশের পথ, তখন মা তাকে জিজ্ঞেস করল,
“ছেলের নামকরণ হয়েছে?”
রিক্সাচালক ঘাড় হেলিয়ে জানাল, “আজ্ঞে, হ্যাঁ…”
মা – “কি নাম রেখেছ?”
রিঃচাঃ – “আজ্ঞে, খুব ভাল নাম, আমাদের খুব পছন্দ হয়েছে বাইচান্স”
মা – “তো নামটা কি?”
রিঃচাঃ (ঘাড় ঘুরিয়ে, আওয়াজটা একটু তুলে) – “ওই যে, বাইচান্স। বাইচান্স মাহাতো!” তার মুখে একটা গর্বের হাসি ফুটে উঠল।

আমি আর মা প্রায় আঁতকে উঠলাম। মা যথাসাধ্য গলাটাকে শান্ত করে জিজ্ঞেস করল, এমন নাম তারা কোথায় পেল? রিক্সাচালক বিনয়ের সঙ্গে জানালো, এরকমই একদিন আমাদের স্কুল-এর কোন ছাত্রদ্বয়কে ফেরী করতে করতে তাদের উত্তেজিত বাক্যালাপের মধ্যে এই কথাটা তার কানে আসে। কথাটার সে অর্থ জানেনা বটে, কিন্তু অচেনা শব্দটা তার খুব পছন্দ হয়েছে, মনে একটা অনুরণন জাগিয়েছে। সে জানে এই ইস্কুলের ছাত্ররা ইংরেজী-টিংরেজী পড়ে, সেই ভাষারই কথা হবে হয়ত। তাই সে সেইটাই নাম হিসেবে রেখেছে।

বলতে বলতেই স্কুলের গেট এসে গেল; এই একটা ওকেশন-এ রিক্সাদের হোস্টেল-এর দরজা পর্যন্ত যেতে দেওয়া হোতো। মা-কে গেস্ট হাউসের দরজার কাছে নামিয়ে দিয়ে আমি হোস্টেল অব্দি এলাম, দরজার কাছে ট্রাঙ্ক আর ব্যাগ নামিয়ে নিলাম, মা আগেই ভাড়া মিটিয়ে দিয়েছিল। রিক্সাচালক একগাল হেসে চলে গেল। আমি একটা মানসিক দ্বন্দ্বের ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে রইলাম, এই চালক ভদ্রলোককে কি আমার আসল অর্থটা বলে দেওয়া উচিত ছিল? আমি কি নির্দোষ শিশুটির ইহকাল পরকাল ঝড়ঝড়ে হয়ে যাবার পিছনে দায়ী হয়ে থাকব?

প্রসূন অবশ্য শুনে বলল, “আরে, চিন্তা করিসনা। ঠিকই আছে। ওই হঠাৎ করে হয়ে গেছে হয়ত; বুঝতে পারেনি বোধহয়…”

খুব একটা আশ্বস্ত হলাম না।

8 thoughts on “হঠাৎ করে, ভাগ্যক্রমে

কেমন লাগল? লিখে ফেলুন!