টেক্সাস রাজ্যের হিউস্টন-এ ২০১৫-র উত্তর আমেরিকা বঙ্গসম্মেলন-এ যোগ দিতে গেছিলাম গত সপ্তাহের শেষে। সেখানে একটা অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা হলো, সেটা সবার সঙ্গে ভাগ না করে নিলে ঠিক পোষাচ্ছে না। রবিবার (গতকাল, সম্মেলন-এর শেষ দিন) দুপুরবেলা মধ্যাহ্নভোজের লাইন-এ দাঁড়িয়ে আছি, হাতে ট্রে, তার ওপর কাগজের প্লেট – সামনে পিন-পিন করে জ্বলা অগ্নিশিখার ওপরে রাখা অ্যাল-ফয়েল-এর ডিব্বায় রান্না করা বিভিন্ন পদ, লাইন চলতে চলতে সামনে দাঁড়িয়ে লোকে হাতা দিয়ে দিয়ে তুলে নিচ্ছে। আমিও তাই করছি, তখনি আমার ঠিক পিছনে দাঁড়ানো দু’জন ষাটোর্দ্ধ পক্ককেশ ভদ্রলোকের কথোপকথন কানে এল।
মন্দিরে মম কে?
আজকাল কাজের জ্বালায় লেখার একটুকু সময় পাইনা। মাঝে মধ্যে যদিবা বন্ধু-বান্ধবের লেখাপত্র একটু চোখ বোলানোর সময় করে নিই, কিন্তু নিজে বসে লেখা? হায়। যাকগে, সে হতাশার মাঝ থেকেও চেগে উঠলাম একবার কুন্তলার অনুপ্রেরণায়… অবশ্য তার বিন্দুবিসর্গও কুন্তলার জানার কথা নয়। না, ভুল হল; এতে কুন্তলার কোনো হাত নেই। অনুপ্রেরণাটা এল কুন্তলার ভক্ত পাঠিকা/পাঠক-কূলের একজনের একটা কমেন্ট থেকে। একটু ফিস্ফিস্ করেই বলে ফেলি, কেমন?
লান সু ইউয়ান চৈনিক উদ্যান – চতুর্থ কিস্তি
লান সু ইউয়ান-এ বিদ্যাভ্যাস, চিন্তন, মনন শেষে চলুন আরো এগিয়ে যাই, নাকি? এখনো অব্দি কেমন বুঝছেন?
লান সু ইউয়ান চৈনিক উদ্যান – তৃতীয় কিস্তি
মৎস্যজ্ঞান লাভ শেষে চলুন এগিয়ে যাওয়া যাক। এখান থেকে বাঁদিকে বেঁকে পায়ে চলার পথ, ‘চতুষ্কোণ ক্র্যাব্যাপ্ল বাঁধুনি’র পাথরের রাস্তা, তার ওপর হেঁটে সুবিশাল বাঁশঝাড় অতিক্রম করে এগিয়ে যেতে হয়। দেওয়ালের পাশে রাখা দু’টো সরু পাথরের স্তম্ভ, তাদের নাম ‘মঞ্জরী প্রস্তর’ কারণ তাদের দেখতে বংশমঞ্জরীর মতন; চীনদেশের য়ুনান এবং জ়েজিয়াং অঞ্চল থেকে আমদানী করা ভিন্নভাবে ক্ষয়ীভূত পাললিক শিলা।
আরো এগিয়ে গেলেই একটা একতলা বাড়ি, তার নাম ‘স্বচ্ছ লহরীতে অনুচিন্তন’ বা ‘রিফ্লেকশন্স ইন ক্লীয়ার রিপ্ল্স’; এর ব্যবহার ঘরোয়া বৈঠক বা আড্ডার জন্য। পিছনের জানলা দিয়ে তাকালে বাইরে দৃশ্যাবলী জানলার ফ্রেম-এর মধ্যে ধরা পড়ে, পাথর, পাইন, বাঁশ, আবহাওয়া, সময় এবং ঋতুর সঙ্গে সঙ্গে সেই দৃশ্যপট বদলে বদলে যায়।
অনুচিন্তন শেষে এখান থেকে বেরিয়ে চলার পথ অনুসরণ করে এগোলেই সামনে পড়ে একটা বড় উঠান। ‘সুবাসের অঙ্গন’ বা ‘ফ্রেগ্রেন্স কোর্টইয়ার্ড’ হল অধ্যয়নকক্ষের পথে দু’টি উঠানের প্রথমটি। দু’টিতেই লাগানো থাকে নানারকম সুগন্ধী ফুলের গাছ (যেমন গন্ধরাজ, জুঁই, কিমোন্যান্থাস, হানিসাক্ল্, ফিলাডেলফাস, ইত্যাদি) যাতে সেই সৌরভ কাজের সময় শিল্পী বা বিদ্বান ব্যক্তির নাসিকাগোচর হয়। যেহেতু এরা বছরের বিভিন্ন সময়ে ফোটে, তাই সারা বছরই ভিন্ন ভিন্ন ধরণের গন্ধ পাওয়া যায়। সামনেই চন্দ্রদ্বার বা ‘মুন গেট’, যার ওপরে খোদাই করা আছে, “ভূমিচিত্র অধ্যয়ন কর”, আবার এর ঠিক অন্যপাশে লেখা আছে, “গন্ধগুলোকে শোন” – এর উদ্দেশ্য হল, ভ্রমণকারীকে মনে করিয়ে দেওয়া যে সুজৌ বাগানকে সম্পূর্ণ উপভোগ করতে হলে পঞ্চেন্দ্রিয়কে সজাগ থাকতে হবে। যেমন, ড্রিপ টাইলগুলো। ছাদ থেকে বৃষ্টির জল বয়ে যায় ঝুলন্ত ড্রিপ টাইল পর্যন্ত, তাদের গা বেয়ে ঝরে পড়ে পুঁতি-বসানো পর্দার মত বা ঝর্ণায়মান মুক্তোর মত। অনেক সময়, প্রশস্ত পাতাওয়ালা গাছ ঠিক এই টাইলগুলোর নিচে বসানো হয়, যাতে বৃষ্টির জল পড়লে বেশ শ্রুতিমধুর একটা শব্দসৃষ্টি হয়। চন্দ্রদ্বার পেরোলেই বিদ্বজ্জনের অঙ্গন।
এই দ্বিতীয় উঠানের বৈশিষ্ট্য হল প্রথমেই চোখে পড়ে দেওয়ালে ‘সছিদ্র বাতায়ন’ যা দিয়ে বাইরের দৃশ্যাবলী যেন ছিদ্রপথে ঢুকে পড়ে চক্ষুগোচর হবার জন্য। সর্বমোট ৫২টি এমন জানলা আছে পোর্টল্যাণ্ড-এর সুজৌ উদ্যানে। পায়ের নিচে এখানে যে মোজ়াইকের নকশা দেখা যাবে, তার নাম হল ‘চিড়-খাওয়া বরফের ওপর মুকুলিত বড়ই’ বা ‘প্লাম ব্লসম্স্ অন ক্র্যাক্ড আইস’; কাছাকাছি দু’টো বড়ই গাছ বাইরের দেওয়ালের ধারে লাগানো; শীতের শেষদিকে তাদের মুকুলগুলো উঠানে ঝরে পড়ে। যেহেতু বড়ই শীতের তোয়াক্কা না করেই ফুল দেয়, তাকে ন্যায়পরায়ণতা এবং শক্তির প্রতীক হিসেবে মানা হয়।
ওপরঃ বাঁয়ে – বিদ্বজ্জনের অঙ্গন; ডাইনে – প্লাম মোজ়াইকের নকশা; নিচেঃ দেওয়ালের মধ্যে লীকি উইন্ডো, বা সছিদ্র বাতায়ন
এগোলেই পড়বে বিদ্বজ্জনের অধ্যয়নকক্ষ, যার কাব্যময় নাম ‘পরিব্যাপ্ত সুবাসের স্বর্গীয় দালান’ বা ‘সেলেশ্চিয়াল হল অফ পারমিয়েটিং ফ্রেগ্রেন্স’ – এটি বাড়ির মূল কক্ষ, তাতে দিবাশয্যা এবং বসার সরঞ্জামাদি রাখা রয়েছে; এখানে বসে হয়ত শিল্পী বা বিদ্বান ব্যক্তি তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে দর্শন, অঙ্কন, কাব্য, বা মহার্ঘ কোন প্রাচীন বস্তু নিয়ে গভীর আলোচনায় মগ্ন হবেন। অথবা হয়ত ‘দ্বিপদী খেলা’-জাতীয় বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিযোগিতায় নামবেন, যেখান একজন দু’লাইনের কবিতার প্রথম লাইনটি বলবেন এবং অন্যজনকে দ্বিতীয় লাইনটি তৈরী করে বলতে হবে। এর উদাহরণও আছে এই ঘরটিতে। দিবাশয্যার দু’পাশে চৈনিক ফার গাছের কাঠ দিয়ে নির্মিত দু’টো স্তম্ভ আছে, তাতে চৈনিক দ্বিপদী কবিতার এক একটা লাইন খোদাই করা আছে; একটি বলছে, “একাকী তরুবর পৃথিবীকে পথ দেখায় বসন্তবরণে” আর অন্যটিতে লেখা, “বরফের মধ্যেও দশ সহস্র ফুল সাহস করে ফুটে ওঠে” – ঈঙ্গিত ঘরের বাইরেই দাঁড় করানো বড়ই গাছগুলোর দিকে।
দরজা এবং জানলাগুলো চৈনিক নান কাঠের, এবং হাল্কা রঙের জটিল নকশার জাফরী এবং তাকগুলো গিংকো কাঠের। তাকগুলোতে সাধারণত সেই বাড়ির মালিকের সংগ্রহের কোন মহার্ঘ বস্তু রাখা থাকবে। মূল কক্ষের বাইরে একটা চিহ্নিত ছোট অঞ্চল ব্যবহৃত হবে লিপিবিদ্যা বা কাব্য-অঙ্কনাদি চর্চায়। এই অঞ্চলটার নাম, “সবুজের গুচ্ছে অর্ধ-বাতায়ন” বা “হাফ এ উইন্ডো ক্লাস্টার্ড ইন গ্রীন”।
ওপরেঃ বাঁয়ে – জাফরীকাটা জানলার পাশে কবিতার স্তম্ভ; মধ্যে – ঘরের ভিতরের বিন্যাস; ডাইনে – মিং সাম্রাজ্যের সময়ের আসবাবপত্রের ইতিহাস; নিচেঃ বাঁয়ে – বিভিন্ন নকশার জাফরী; মধ্যে – বাহারে জানলা; ডাইনে – অর্ধ-বাতায়নের বিন্যাস
দেখা কিন্তু আরো বাকি আছে, সুতরাং চলুন যাই। [চতুর্থ কিস্তি]
লান সু ইউয়ান চৈনিক উদ্যান – দ্বিতীয় কিস্তি
লান সু ইউয়ান-এ ঢুকে পড়েছেন তো? এবার এখানেই চারপাশটা একটু নজর করে দেখা যাক।
লান সু ইউয়ান চৈনিক উদ্যান – প্রথম কিস্তি
নর্থওয়েস্ট থার্ড অ্যাভেনিউ এবং এভারেট স্ট্রীট-এর সংযোগস্থলে অবস্থিত পোর্টল্যাণ্ড-এর ক্লাসিকাল চৈনিক উদ্যান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উত্তরপশ্চিমের ওরেগন রাজ্যের শহর পোর্টল্যাণ্ড এবং তার ‘সহোদরা শহর’ চীনদেশের জিয়াংসু অঞ্চলস্থিত সুজৌ – এই দুই শহরের পারস্পরিক সহযোগিতায় তৈরী এই মনোরম প্রতিষ্ঠানটি।
সুজৌ শহর, যার গোড়াপত্তন হয় ৫১৪ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে, সেদেশের সর্বপ্রাচীন শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম। পূর্ব উপকূলবর্তী সাংহাই-এর ৬০ মাইল পশ্চিমের শহর সুজৌ, পোর্টল্যাণ্ড-এর মতনই তার আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ। ১০০০ খ্রীষ্টাব্দ নাগাদ সুজৌ খ্যাতিলাভ করে তার বাণিজ্যভিত্তিক বর্ধিষ্ণু অর্থনীতির জন্য, ফলে সেটি অনেক সরকারী পদে আসীন শিল্পীর আবাসস্থল হয়ে দাঁড়ায়। এই ধরণের অনেক পদাধিকারী-শিল্পীর বাড়ির অভ্যন্তরে একটি করে সুন্দর বাগান তৈরী করা হোতো; উদ্দেশ্য ছিল প্রকৃতির স্পর্শ একটুকরো বাঁচিয়ে রাখা, অনেকটা যেন প্রখ্যাত চৈনিক ল্যাণ্ডস্কেপ পেইন্টিং-এর প্রাণবন্ত বহিঃপ্রকাশ। ধ্যান-মনন, কাব্যসৃষ্টি বা চিত্রকারী, উদ্যানবিদ্যার চর্চা, বা নিছক বন্ধু বা পরিবার-পরিজনের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার জন্য আদর্শ জায়গা ছিল এই বাগানগুলো।
হনুমানের প্রতিশোধ
আগের দিন শাখামৃগোপাখ্যান লিখতে গিয়ে মা-এর সঙ্গে বাঁদরের বাঁদরামি নিয়ে অনেক গল্প হয়েছিল। তাতেই ধীরে ধীরে জানতে পারলাম যে উক্ত প্রাণীকূলের সঙ্গে আমাদের বেশ খানদানী সম্পর্ক – তাই বেশ কয়েকটি রোমহর্ষক কাহিনী থলের ভিতর থেকে বেরিয়ে পড়লো। সেই ঘটনাসমূহ সকলের সঙ্গে ভাগ করে নিতে না পারলে আমার ঠিক প্রাণে শান্তি হচ্ছে না। অতএব, সাধু সাবধান… এই ঝুলি নড়ছে, এ-এ-ই ঝুলি নড়ছে…
শাখামৃগোপাখ্যান
ক’দিন পূর্বে আমার বন্ধু মধুবন্তীর মুখপুস্তিকার পাতায় একটি মজার ছবির দর্শন মিলিয়াছিল – একটি ঘুমন্ত বাঁদর। চার-হস্ত-পদ একত্রিত করিয়া, খুব সম্ভবত নাসিকাভ্যন্তরে সর্ষপতৈল নিক্ষেপপূর্বক সে পরম শান্তিতে দিবানিদ্রায় নিমগ্ন – এমতাবস্থায় কোন উৎসাহী প্রকৃতিপ্রেমী চিত্রগ্রাহক/গ্রাহিকা তাহাকে ক্যামেরাবন্দী করিয়া ফেলে।
মাতামহীরুহ
প্রতিদিন সকালে আমার ই-মেইল-এ বেশ অনেকগুলো করে কমিক্ স্ট্রিপ আসে। সেই ছোটবেলার অভ্যেস – আনন্দবাজারটা এলেই দ্বিতীয় পাতার নিচের বাঁদিকের কোণে অরণ্যদেব আর ম্যানড্রেক যাদুকরের গল্পে চোখ বুলিয়ে নেওয়া – সেইটা এখনও ছাড়তে পারিনি। অরণ্যদেব-ম্যানড্রেক এখনও পড়ি, তার সঙ্গে জুটেছে আরও গোটা দশ বারো বিভিন্ন লেখকের তৈরী কমিক্স্ – বিভিন্ন ধরণের। তার মধ্যে একটা হোলো “জিট্স্” – একটা টিন-এজার ছেলে, তার মা-বাবা এবং বন্ধুবান্ধবের গল্প। সবসময়ে যে এই ধরণের কমিক্স্-এর সঙ্গে নিজেকে আইডেন্টিফাই করতে পারি, তা নয় – অনেক সময়েই অজান্তে একটা “আমাদের সময়ে বাবা এরকম ছিলনা…” গোত্রীয় বুড়োটে চিন্তা চলে আসতে চায়। কিন্তু আজকের স্ট্রিপ-টা দেখে হঠাৎ ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেল।
ফুচকার আখ্যান
এরম করলে খেলবনা। জানি কুন্তলা ভাল লেখে, দুর্দান্ত লেখে; জানি তার অসাধারণ পর্যবেক্ষণ শক্তি এবং বর্ণনার ক্ষমতা, তার কলম থুড়ি কীবোর্ড-এ সাক্ষাৎ সরস্বতীর অধিষ্ঠান। কিন্তু তাই বলে ফুচকা নিয়ে এমন লিখবে, এত মনোগ্রাহী একটা লেখা? প্রচণ্ড হীনমন্যতায় ভুগে ভুগে জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে গেলাম প্রথমে। তারপরই অবশ্য সম্বিত ফিরল, বলা যায় – ছাই থেকে ফিনিক্স-পাখির মত বেরিয়ে এলাম, ডান কাঁধের দেবদূত বাঁ কাঁধের হিংসুটে শয়তানকে একটা সাধারণ প্রশ্ন করল, যখন নবনীতা দেবসেন-এর লেখা পড়ি, তখন কি হিংসা হয় আদৌ – নাকি অনাবিল আনন্দে শুধু উপভোগই করি ওনার লেখনীমাধুর্য? ব্যস! সব পারুষ্য অচিরেই উধাও হয়ে গেল, রয়ে গেল একটা চমৎকার লেখা পড়ে ওঠার আবেশ। ওঃ, আমি আগে কখনও বলিনি? কুন্তলার লেখায় আমি নবনীতাদিদির ছায়া পাই যে!